বেনজীর আলম ঐশী
মা অসুস্থ, ওষুধ কিনতে হবেএইটাই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কারন সময়মতো মা’র অষুধ কিনে যদি বাড়ি না ফিরি তাহলে হয়তো বাবার মতো মাকেও হারিয়ে ফেলব।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মা বলছিল, “আজ থাক, কাল আনিস মা। এক রাতে কিছুই হবেনা আমার।“ আমি জোর গলায় বলেছিলাম, “আজকে যদি আমি ছেলে হতাম, তাহলে থামাতে না, মেয়ে বলে যেতে মানা করছ।“ মা মুচকি হেসে বলেছিল, “বুঝবি নারে! যেদিন নিজে মেয়ে সন্তান জন্ম দিবি সেদিন বুঝবি কেন মানা করলাম আজকে।“ আমি অবশ্য মার কথা পুরো না শুনেই বেড়িয়ে গিয়েছিলাম, দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম মায়ের সাবধান বানী, “দেখে শুনে যাসরে মা! এই মাঝরাতেই রাস্তায় অনেক নিশাচর কুকুর থাকে।“
চারিদিকে অন্ধকার, মনে হচ্ছিলো এই নিশ্চুপ, ঘুঁটঘুঁটে আধারটা আমাকে চিৎকার করে কিছু বলতে চাইছে। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম না। সব বন্ধ, একটা দোকানও খোলা নেই। কিছুক্ষণ যাবার পরই অবশ্য দূরে একটা আলোর রেখা দেখতে পাই। ভয় পেলেও মনকে প্রবোধ দেই। সামনে এগিয়ে দেখি ঠিক ওষুধ এরই একটা দোকান। মনে মনে হাসছিলাম, মায়ের ভয় আর ভুল ধারনা নিয়ে। যে কুকুরের ভয় মা দেখালো তাতো নেইই বরং ওষুধের দোকানটাও পেয়ে গিয়েছি ঠিকঠাক।
দোকানটা তবু বেশ অনেকটা দূরেই বলা চলে। হাঁটতে হাঁটতে বাবার বলা মুক্তিযুদ্ধের সেই গল্পগুলো ভাবছিলাম।
‘৭১ সালে আমার বাবা ছিলেন ২১ বছর একজন দেশপ্রেমিক বীর যুবক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ যখন ভাষণ দিয়েছিলেন আমার বাবা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে নিজের রক্ত দিয়ে হলেও এই দেশকে স্বাধীন করে ছাড়বেন, আসতে দেবেন না আর কোন মা বা বোনের সম্মান এ কোন আঘাত।
আমি যখন ছোট ছিলাম বাবা আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতেন আর বলতেন দেশটাকে শুধু পুরুষরাই স্বাধীন করেনি, মহিলাদেরও অসামান্য অবদান ছিল। তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন, কেউ কেউ মুক্তিসেনাদের সাহায্য কারেছেন সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে, কেউ লুকিয়ে যুগিয়েছেন খাবার আর কেউবা দিয়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই।
বাবার কথাগুলো আমাকে সবসময় অনুপ্রেরনা দিতো।আমি প্রায়ই ভাবতাম কিভাবে এই নয় মাসের কঠোর যুদ্ধে সকল এর অবদান ছিল সমান এবং একই সাথে বর্ননার অতীত। এই বীর ও বীরাঙ্গনাদের কারনেই আমরা একটা স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার নিশ্বাস নিতে পারছিলাম। বাবার কথা চিন্তা করতে করতেই আধো অন্ধকারে পৌঁছে গেলাম দোকানের পাশটায়।
দেখলাম মধ্যবয়স্ক একজন লোক পেপার পড়ছে। খুব অসাধারণ কিছু চোখে পড়ল না। পাড়ার পুরনো দোকানগুলরই একটা। দেখে বুঝলাম বিক্রেতাই হবে লোকটি, আশেপাশে আর কাউকে না দেখে।মার ওষু্ধের প্রেস্ক্রিপশান হাতে দিয়ে বললাম, “চাচা, আমাকে এই ওষুধগুলো একটু জলদি দেবেন? বাসায় মা অনেক অসুস্থ, দ্রুত ফিরতে হবে।“
ধীর স্বরে আমি লোকটিকে বলতে শুনলাম ,”মা, এই ওষুধগুলো ভেতরে, তুমি কি আমাকে এসে একটু সাহায্য করবে? শেল্ফ এর ওপরে আছে, আমি নামিয়ে দিলে তুমি ধরো।“
আমিও কিছু না মনে করে তার কথামতো রুমের দিকে আগালাম। তারপর কি হলো আমার সাথে জানতে চান? অনুমান করে ফেলেছেন কি কিছুটা?
যে লোকটা আমাকে মা ডেকে সাহায্যের জন্য ভেতরে নিয়ে গেলো সেই মানুষটাই রুমের দরোজা বন্ধ করে আমার মা রাস্তার যেই মাংশাসী কুকুরের কথা বলছিল সেই বিকট প্রানীতে পরিণত হল।
আমি চিৎকার করলাম কিন্তু রাস্তায় কোন কুকুর ছিল না। আমার দেহ থেকে যখন এই পিশাচটা মাংশ ছিঁড়ে খাচ্ছিল, রাস্তায় কোন কুকুর ছিল না- চারপেয়ে নিরীহ প্রানীটার কথা বলছি। তবে এখানেই কি গল্পের শেষ?
না, ওই পাষানটার বুকে ভয় ঢুকে গেলো যদি আমি ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলে দেই? তাই রুমের কোনায় রাখা একটা ভারী হাতুরি দিয়ে ও আমার জীবনটাই শেষ করে দিলো।
তুমি ভুল ছিলে মা, রাস্তায় কোন কুকুর ছিল না, ছিল মানুষরুপী কুকুর! বাবা তুমিও ভুল বলেছিলে, “দেশটা সবাই মিলে স্বাধীন করেছে আর এই বিজয়ীর দেশে সবাই সবার আপন।“ তুমি ভুল ছিলে যখন তুমি গর্ব করে বলেছিলে যে মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে একসাথে দেশটিকে স্বাধীন করেছে এবং মানুষকে এখানে মানুষের সম্মান দেয়া হয়।
আমিও কি ভুল ছিলাম বাবা তোমার বলা গল্প থেকে বীরাঙ্গনা হয়ে উঠতে না পেরে, এই ইবলিশ এর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে? পারিনি আমি এই বিজয়ের দেশে বিজয়ীর বেশে নিঃশ্বাস নিতে।
বাবা, তবে কি তোমরা নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এমনই একটা দেশ চেয়েছিলে? এইকি আমাদের সবুজ বাংলার নতুন বিজয়ের সংজ্ঞা?