শেষ চিঠি

শেষ চিঠি

সানজিদা আলম


মুহূর্ত।আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত।

শত শত বই পড়েছি এই জীবনে। বড় বড় কবি, মহাকবি, সাহিত্যিকদের নামি দামী বই পড়েছি। তাঁরা সবাই হরেক রকম বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁদের মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। অনেক কিছু জানতে পেরেছি। শিখতে পেরেছি। কিন্তু কোনো বই বা কেউ আমাকে এটা বলতে পারে নাই যে মৃত্যুর অনুভূতিটা ঠিক কেমন। আর বলবেই বা কিভাবে? মৃত্যুর অনুভূতি তারাই বলতে পারবে যারা মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করেছে। যাঁরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় মৃত্যু বরণ করা মানুষগুলো তাদের মৃত্যুর বর্ণনা দেওয়ার সক্ষমতা রাখেনা। কিংবা চাইলেও তা পারেনা। কারণ মৃত মানুষ তো না-ফেরার দুনিয়ায় চলে যায়। সেইখান থেকে ফিরার উপায় নেই। আর যারা জীবিত তারা কখনও মৃত্যুর মুখোমুখী হয়নি। তাই তারাও মৃত্যুর বর্ণনা দিতে অক্ষম। 

তবে আমি পারবো।

মৃত্যু হতে বেশি সময় বাকি নেই। তাই যতটা পারি লিখে রেখে যাচ্ছি। এটার নাম দিচ্ছি “শেষ চিঠি” l মৃত্যুর আগের শেষ চিঠি। 

জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার ঠিক আগ মুহূর্ত যুদ্ধের থেকে কিছু কম নয়। চোখ খোলা রাখার যুদ্ধ। শেষ বারের মত দুনিয়ার আলো দেখার যুদ্ধ। এটা সেই সময়ের বর্ণনা দিচ্ছি যখন আপনার হৃদ স্পন্দন এতটাই দ্রুত হয়ে গেছে যে মনে হবে আপনার পাজোরের হাড় গুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে হৃদয়টা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। আর ঠিক সেই সময় আপনিও আমার মতো পিপাসাতে মরিয়া হয়ে উঠবেন। প্রিয় মানুষটিকে শেষ বারের মত দেখার পিপাসা। শেষবারের মতো তার নাম ধরে তাকে ডাকার পিপাসা। 

জীবনের শেষ মুহূর্তে আপনার হয়তোবা মনে পড়বেনা মা কে কিনে দেওয়া শাড়ীটার দাম কতো ছিল, কিন্তু ঠিকই মনে থাকবে সেই শাড়ীটা পেয়ে আপনার মা কত খুশি হয়েছিল। হয়তোবা আপনার মনে পড়বেনা আপনার মেয়ে আপনাকে কবে প্রথম বাবা বলে ডেকেছিল, তবে সেই বাবা ডাক শুনার পরের অনুভূতিটা আপনার ঠিক মনে থাকবে। ভালোবাসার মানুষটিকে প্রথম কবে লাল গোলাপ কিনে দিয়েছিলেন? মনে আছে? বন্ধুর সাথে কুড়ি বছর আগে ঠিক কি নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল, মনে পরে? এসব কিছুই আর জীবনের শেষ মুহূর্তে মনে থাকেনা। শুধু মনে থেকে সেই দিন গুলোর অনুভূতি গুলো। 

আহহ! পুরোই নস্টালজিক! খুশির দিনগুলো নিয়ে ভাবতে কারোইবা ভালো লাগেনা? যখন পুরনো দিনের কথাগুলি মনে পড়বে আপনার মুখ জুড়ে থাকবে এক শান্তির হাসি। তবে পরক্ষণেই সেই হাসি মিলিয়ে যাবে। যখন আপনি উপলব্ধি করবেন যে মানব জীবনের সব অনুভূতির স্বাদ গ্রহণ করার ক্ষমতা আজ আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। 

ভয়! 

হঠাৎ করেই আপনি ভয়ের সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছেন। যতই উঠার চেষ্টা করেননা কেনো ভয়, আশঙ্খা, দুশ্চিন্তা আপনাকে ঘ্রাস করে সমুদ্রের তলদেশে ডুবিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রিয় মানুষের হাসি আর কোনোদিন না দেখতে পাওয়ার ভয়। তাদের স্পর্শ না করতে পারার ভয়। কাউকে ভালোবাসতে না পারার ভয়। কারো ভালোবাসা না পাবার ভয় । মনের কথাগুলো না প্রকাশ করতে পারার ভয়। শেষ হয়েও যেনো সব কিছু শেষ না হওয়ায় ভয়। মহাকাব্যের বর্ণিত ধুদ্ধের থেকেও এ এক বড়ো যুদ্ধ। এমন এক যুদ্ধ। যেই যুদ্ধে নেই কোনো জয়। আছে শুধু পরাজয়। 

উপলব্ধি! 

এতক্ষনে আপনি হয়তোবা উপলব্ধি করতেই পেরেছেন যে এই যুদ্ধে হেরে গেলেই আপনি জিতে যাবেন। সময় এর সাথে যুদ্ধ করে আর হবেই বা কি? সময় না কোনোদিন কারো জন্য থেমে ছিল। না কোনোদিন থেমে থাকবে। 

সময়! 

আরো অনেক কিছু লিখার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু সময়?

সময় আজ বড্ড বেশি বেইমানি করছে।