ছুটির দিন

ছুটির দিন

জান্নাতুল ফেরদৌস সানজিদা


নিতুর আজকের দিনটা অনেকটাই হালকা মনে হচ্ছে। যে যাই বলুক এত এত চাপ আর নেওয়া যাচ্ছিলো না। ছুটিটা আসলেই দরকার ছিলো। আনমনেই সে বই এর তাক গুছাতে গুছাতেই একটা গান ছাড়লো। হিপ-হপ ধরনের। 

-“জানিস নিতু, এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। ১৪ই ডিসেম্বর রাত আড়াইটার কাছাকাছি…” 

(নিতু মোবাইল ফোনের গানটা বন্ধ করে কথায় মনোনিবেশ করল।) 

“হঠাৎ ঘুম ভেঙে পূর্ব পাশের জানালায় তাকাতেই দেখি মাস্টার বাড়িতে আগুন লেগেছে। দাউ দাউ আগুন জ্বলছে।  ননীদির বিভৎস চিৎকারে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তার বিলাপের সুরের অভিসাপ দূর থেকে ভেসে আসছে, বলছেন- ‘জানোয়ারের দল! ভগবান যে আছে কুত্তার বাচ্চারা ভুইল্লা গেছে। আমার সব কিছু কাইড়া নিয়া জালায় দিবি ভাবসোস? দিনঘনায় আইতাসে।’ চিৎকার মিশ্রিত আক্রোশের পাশাপাশি পূর্বমুখী ভাঙ্গা জানালা দিয়ে আগুনের ফুল্কিও আসছিলো। হঠাৎ কেমন যেন অজানা ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। ভগ্ন-ঘুমাবস্থায় অন্ধকার ঘরে নিজেকে খুজে পেলাম। একটা ভেজা হাত খপ করে হেঁচকা টান দিতেই জোরে চিৎকার করে উঠলাম। সেই চিৎকারেই পৃথিবীটা নিমিষেই পাল্টে গিয়েছিলো।”

-“বাবা, কি হয়েছিলো তারপর?”

-“হাতটা তোর দাদাভাইয়ের ছিল। রক্তে ভেজা। গুলিতে পা ঝাঁঝরা হয়েছিলো, আব্বা কেমন যেন অস্ফুট চাপা গোঙ্গানির মতো আওয়াজ করছিলেন। মিলিটারিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আম্মার  সাহায্য নিয়ে আব্বা এসেছিলেন শেষবারের মতো আমাকে দেখতে। আমি যেন চিৎকার না করতে পারি তাই আব্বা আমার মুখ চেপে ধরেছিলেন। পাশেই আম্মা কাঁদছেন…চাপা কান্না… শব্দ নেই। আগুনের ফুলকি-ঝলকের সাথে আম্মার অশ্রুরেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তখনও আমি হতভম্ব। আম্মা কাঁদছেন আর শাড়ীর আচলটা মুড়িয়ে দিচ্ছেন আব্বার পায়ে।”

চশমাটা চোখ থেকে খুলে টেবিলের পাশে রাখতে রাখতে ওয়াহিদ সাহেব বলে চললেন- “আব্বা হঠাৎ গোঙ্গানি থামিয়ে আমার কপাল টেনে আলতো চুমু খেলেন। কোনো কথা বললেন না।শুধু টের পেলাম,

 এক ফোটা পানি তার চোখ গরিয়ে আমার গালে লাগলো। আব্বা আম্মার দিকে তাকালেন। সেই সময় হঠাৎ খট্ খট্ ধাক্কায় দরজা প্রবল বেগে কাঁপতে লাগলো। দরজার বাপাশের ২-৩ হাত দূরে দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ থেকে মিলিটারির হাতে থাকা রাইফেলের নলের ছায়া ঘরের মেঝেতে এসে পড়লো। ছায়াটা অনবরত নড়ছে।

দরজার ঐপারে ভারী কন্ঠে কেউ একজন বলে উঠলো- “স্যার, প্রফেসরের বাইচ্চাটা এনে হানসে। কুদ্দুইচ্চা!  আরো জোরে বাড়ি দে!  ভাইঙ্গালা! শুয়ারের বাইচ্চায় গাতাত ডুকছে।” একথা শুনে সাথে সাথে আব্বা আম্মাকে আবছা কন্ঠে বললেন- “যাও”।  বলামাত্রই আম্মা আমাকে চেংদোলা করে  জানালার কাছে নিয়ে গেলেন, মুখ শক্ত করে বললেন-“বাইচা থাকলে অমাইনষের বাচ্চাটিরে বাঁচতে দিস না। ” কিছু বুঝে ওঠার আগেই আম্মা আমাকে নালায় ফেলে দিলেন।”

নিতু আঁতকে উঠে বললো- “তারপর?”

-“ তেমন একটা গভীর ছিল না তাই সাতার না জানা সত্ত্বেও হাবুডুবু খেতে খেতে ঝোপের ডাল ধরে উঠে এলাম। আম্মার চিৎকার শুনতে পেলাম আর সাথে চারটা গুলির শব্দ। একপাশে আমার আগুন জলে, অন্য পাশে গুলি। ঝোপের আড়াল থেকে লক্ষ করলাম, মিলিটারিদের একজন নালার দিকে তাক করে কয়েকটা ফাঁকা গুলি ছুড়লো। একটা গুলি আমার পাশ কেটে আমার সামনে দিয়ে যাওয়া বিড়ালটার উপর লাগলো। এর আগের দিন বিড়ালটাকে আমার ভাগের মাংসটা আম্মাকে না জানিয়ে খাইয়েছিলাম। শীতে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভাবছিলাম হয়তো আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। “

-“বাবা কিভাবে সহ্য করেছ এসব?” চোখেরজল মুছতে মুছতে ওয়াহিদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরল নিতু।

-“জানি না রে মা। সেদিন মনে হয়ছিলো আট বছরেই আমি পৃথিবী দেখে ফেলেছি।  হয়তো তোদেরকে দেশপ্রেমের জন্য তারা কি করেছিলো, তা জানানোর জন্যই হয়তো এখন পর্যন্ত বেচে আছি। আজকের দিনটা শুধু ছুটির দিন না… আমাদের জন্য বিশেষ দিন।”