আনিকা হৃদি
‘ভাই, সামিউল। তুই আগামীকাল থেকে শার্টের নিচে বক্ষবন্ধনী পরে আসিস। ভাই, তোরে সেই লাগবে।’
সামিউল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে রেখেছে তিনজন। রাব্বির কথাটা শুনে কষ্ট পেলো কি সামিউল? আমাদের দশম শ্রেণীর ছাত্রদের শ্রেণীকক্ষটা বিশাল বড়। আমি সামনের বেঞ্চে বসে বই পড়ছি আর অয়ন, মিহির, রাব্বির কার্যকলাপ দেখছি। প্রতিদিনের মতো আজ আবার তারা সামিউলকে ক্ষেপাচ্ছে। সামিউল দেখতে কালো, মোটা। শরীরে চর্বির স্তরগুলো শার্টের বাইরেও ভাসা ভাসা। চোখে মোটা গোল চশমা। অয়ন শরীরটা হেলিয়ে দুলিয়ে বললো,
‘শোন, বাজারে একটা নতুন ক্রিম আসছে। কিনে ভালো করে মাখবি দেখবি নায়িকাদের মতো চকচকে হবে তোর ত্বক।’
মিহির সামিউলের পেটে একটা ঘুষি দিলো আস্তে করে। হেসে হেসে বললো,
‘খাস কি তুই? তোরে তো হাতির বাচ্চা লাগে।’
সামিউল কাউকে কিছু না বলেই আমার পাশে এসে বসলো। তার মাথাটা নিচু। এটা নিত্যদিনকার ঘটনা। আমি পড়াতে মনোযোগ দিলাম। সামিউল আমাকে ডাকলো,
‘জয়?’
আমি মাথাটা তুলে বললাম,
‘কিছু বলবে সামিউল?’
সামিউল কিছু বললোনা। আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। সামিউলের চোখ দুটো বড় বড়। মায়া হয় দেখলে। সামিউল মাথা নিচু করে বললো,
‘জয়, আমি কি অনেক কুৎসিত দেখতে?’
আমি কিছুটা অবাক হলাম। সামিউল কখনো এমন প্রশ্ন করেনা। আমাদের কলেজের মাঠে একটা অশ্বত্থ গাছ আছে। মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে নির্বিকার। দেখতে জঙ্গলের মতো লাগে। আমি জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বললাম,
‘অশ্বত্থ গাছটা কেমন লাগে তোমার সামিউল?’
সামিউল বোধহয় খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেলো। ওঁর প্রশ্নের উত্তর তো এটা নয়! অবাক কন্ঠে বললো,
‘মানে?’
‘তুমি কি জানো এই গাছটা অনেকের বিরক্ত, ভুতুড়ে লাগে? তোমার কি এমন লাগে?’
‘একটুলাগে।’
‘তোমার কি মনে হয় মানুষ অশ্বত্থ গাছটাকে এমন ভাবে তাই তার খারাপ লেগেছে?’
‘গাছের আবার খারাপ লাগবে কেন?’
‘এই জীবনে চলার পথে আমাদের জড়বস্তু হতে হয়। জীবনটা স্বচ্ছ করতে জড়বস্তু হওয়া বড্ড প্রয়োজন। অনুভূতি থাকলেও নিজেকে অনুভূতিহীন দেখাতে হয়। অশ্বত্থ গাছ দেখতে জঙ্গলের ন্যায়, ভুতুরে। অনেক মানুষ তাকে পছন্দ করেনা। আবার সেই মানুষগুলোই বিপদে ঔষুধি অশ্বত্থের খোঁজ করে।’
সামিউল আমার কথাগুলো শুনে আবার মাথা নিচু করে বসে রইলো। সে কি বুঝেছে, কতটা বুঝেছে আমি ঠাউর করতে পারলাম না।
ঘটনাটা দুইদিন পূর্বের। মাঠে মিহিরের সাথে কথা কাটাকাটি হয় সামিউলের। একপর্যায়ে মিহির সামিউলের শার্টটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে। অনেকগুলো কথা শুনায়। যা হয়তো তার উচিত হয়নি। আমি সামিউলের পক্ষে বিচার নিয়ে স্যারের কাছে গেলাম। স্যারদের হয়তো বড়লোক মিহিরের প্রতি দরদটা বেশি। সুযোগ পেলেই সামিউলকে অপদস্ত করতে স্যারেরা খুব মজা পায় বোধহয়। সবার সামনে বেতের বারি সামিউলের উপরেই পড়লো। মাঠে দাঁড় করিয়ে শাসনটা বড্ড বেশি হয়ে গেলোনা? সারা স্কুলের মানুষ বারান্দায় জমা হয়ে দেখছে। মিহিরকে স্যার তেমন কিছুই করলেন না। আমি পাশে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেক সময় মানুষের মন অনেক কিছু করতে চায় তবে মস্তিষ্ক বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সামিউলের আর্তনাদ করা আর লজ্জায় আড়ষ্ট হওয়া মুখটা আমায় এতো জ্বালাচ্ছে! এরপর কেটে গিয়েছে দুইদিন। সামিউলের দেখা নাই। তার বাড়িও আমি চিনিনা। আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছুটির পর খোঁজ করে তাদের বাড়ি যাবো। ছেলেটাকে বুঝানো প্রয়োজন।
ঘড়িতে সময় চারটা বেজে পঁচিশ মিনিট। অয়নকে নিয়ে সামিউলের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। টিনের ঘর। বাড়ির ভিতর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। আমি অয়নকে ফেলেই দৌড়ে গেলাম ভিতরে।
সামিউলের দেহ ঘরের পাশে একটা আমগাছে ঝুলছে। চোখদুটো খোলা। সেই মায়াবী দুটো চোখ। আমি বাকরুদ্ধ। একজন জীর্ণ শীর্ণ মহিলা হুইল চেয়ারে বসে চিৎকার করছেন। আশেপাশে কত মানুষ। অয়ন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। আজ সেও স্তব্ধ। পুলিশ আসলো। লাশ নামানো হলো। উঠানে একটা শীতল পাটি বিছিয়ে তাতে রাখা হলো সামিউলকে। আর কিছুক্ষণ পর পোস্টমর্টেমের জন্য নেওয়া হবে নিথর প্রাণহীন লাশটা। আমি তাকিয়ে দেখলাম সামিউলের মুখে একটা কিঞ্চিৎ হাসি। যেনো সে এই স্বার্থপরের দুনিয়া থেকে চলে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে। সামিউলের টেবিলের উপর একটা চিরকুট রাখা। তাতে লেখা,
‘রম্য হবো।’
সামিউলের লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। আমি অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলাম কে যেন কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলছে,
‘মানুষের রঙ্গমঞ্চে সঙ সাজবো। আমার বন্ধুগুলোকে খুব হাসাবো। জড়বস্তু হওয়া আমার কাম্য নয়।’
আমি আঁতকে উঠলাম। পুলিশ সামিউলের লাশটা নিয়ে চলে গেলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। উঠানে সামিউলের মা কাঁদছেন। স্বামী হারিয়ে এবার একমাত্র অবলম্বনও হারিয়ে ফেললেন। আমার আফসোস হচ্ছে আরেকটু আগে কেন আসলাম না। ভিষণ দেরি করে ফেললাম। ভিষণ।
(সমাপ্ত)