বনলতার দীর্ঘঃশ্বাস

 Tarin Ahmad Diba


সে অনেককাল আগের কথা। ঠিক কতকাল আগের কথা যদি বলতে বলা হয়, তবে বলবো যখন ছেলেমেয়েদের বই পড়ার এক সিরিয়াস নেশা ছিল তোখোনেরি। বই দেওয়া নেওয়া করতে করতেই কতো বন্ধুত্ব কতো প্রেম হয়ে যেত। তখনো স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার ভূত আমাদের ঘাড়ে ভর করেনি। শখের মধ্যে তখন আমাদের ছিল ডাকটিকিট, পেপার কাটিং আর দেশ বিদেশের পয়সা সংগ্রহের অভ্যাস। আর এন্টারটেইনমেন্ট বলতে প্রতি বৃহষ্পতি-শুক্রবার সবাই মিলে বিটিভিতে সিনেমা দেখা আর ক্যাসেটে অঞ্জন দত্ত আর নচিকেতা। যোগাযোগের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল চিঠি আর প্রতিবেশীর বাড়ির একমাত্র টেলিফোন যাতে পুরো এলাকার সবার কল আসতো। সেইসময় আমার শখ ছিল ক্রাইম রিলেটেড রিপোর্ট কালেক্ট করা। প্রতিদিনকার মতোই সেইদিন সকালবেলা সবার আগে খবরের কাগজ চুরি করে ক্রাইম রিপোর্টগুলোতে চোখ বুলাচ্ছি। ওদিকে বাবা খবরের কাগজ খোঁজা নিয়ে বাড়ি মাথায় করছেন। এক অন্যরকম থ্রিল। পেপার কাটিং কালেক্ট করতে গিয়ে মায়ের হাতে মার আর বাবার বকা তো কম খাইনি! যাইহোক যা বলছিলাম, হঠাৎ একটা খবরে চোখ আটকে গেলো। “লেখক রুমির আত্মহত্যা!”রুমি ভাই আমাদের এলাকার বড় ভাই। গতবছর একুশে বইমেলায় তার লেখা কবিতার বই বেশ নামও করেছে। আমার বিশ্বাস হতে চাইলো না! রুমি ভাই আত্মহত্যা করেছেন! রুমি ভাইয়ের সাথে আমার শৈশবের বেশ মিষ্টি একটা স্মৃতি আছে। রুমি ভাই আর চারুলতাদিদির পাড়া তোলপাড় করা প্রেম। আমার বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। রুমি ভাই আর চারুলতাদি ছিলেন আমাদের পাড়ার রোমিও-জুলিয়েট! আর আমি ছিলাম তাদের ভালোবাসার ডাকপিয়ন। রুমি ভাইয়ের থেকে লাদেন বোমা, কালি পটকা আর কটকটি ঘুষ নিয়ে আমি তাদের প্রেমপত্র পৌঁছানোর কাজ করতাম। চিঠি আর টেলিফোনের যুগে আমাদের মতো বাচ্চারাই ছিল প্রেমিক প্রেমিকাদের এক মাত্র ভরসা। তাদের প্রেম হয়েছিলো বই দেওয়া নেওয়া করতে গিয়েই। যতদূর মনে পড়ে পাড়ার লাইব্রেরীতে বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা কে আগে নেবে এই নিয়ে এক তুমুল ঝগড়া লেগেছিল তাদের। আমার বড় বোনের বন্ধু ছিল চারুদিদি। বোনের কাছে এসে রুমি ভাইয়ের নামে সেকি বদনাম! যাইহোক পরে তাদের মধ্যস্থতা হয় এবং ঠিক হয় যে চারুদি আগে পড়বে। এরপর রুমি ভাই। চারুদী কে লেখা রুমি ভাইয়ের প্রথম প্রেম পত্রও আমিই পৌঁছে দিয়েছিলাম দুই টাকার লাদেন বোমার বিনিময়ে। রুমি ভাই আর চারুদির দেখা হতো আমাদের বাড়ির ছাদে। রুমি ভাই আমাদের বাড়ির পাঁচিল টপকে ছাদে উঠে চারুদীর সাথে কথা বলতো আর আমি পাহারায় থাকতাম। যতদূর মনে পড়ে চারুদির মা তাঁর টেবিলের গোপন বাক্স থেকে রুমি ভাই আর চারুদির চিঠি পায়। এরপর এ নিয়ে রুমি ভাই আর চারুদীর পরিবারের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ওয়ার থ্রি বেঁধে যায়। চারুদির বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। রুমি ভাইয়ের আমাদের বাড়ির কাছাকাছি আসা বন্ধ। তবে আমার যাতায়াত বন্ধ হয়নি। তাদের বিরহের সুযোগ নিয়ে কত যে পিপাসা আইস্ক্রিম আর কলিপটকা বাগিয়েছি আমি তার হিসেব করলে একটা ছোটো খাট দোকান আইস্ক্রিম আর কলিপটকার দোকান দেওয়া সম্ভব! তখন পড়াশুনোর এতো চাপ ছিল না। সন্ধ্যায় পাওয়ার কাট হলেই এলাকার সব বাচ্চারা এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে সন্ধ্যায় নাস্তা আর গানের আসরে পার্টিসিপেট করতাম। এরই সুযোগ নিয়ে আমি রুমি ভাই আর চারুদির চিঠি বিলি করতাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। চারুদির বিয়ে হয়ে যায় তিন দিন পরেই। তখনকার প্রেমগুলোর ইতি হতো এভাবেই! আমার এখনো মনে আছে বিয়ের দিনও রুমি ভাইয়ের চিঠি নিয়ে চারুদি কে দিয়েছি। চারুদিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো। তবে ঘর আলো করা সুন্দর নয়। বিয়ে বাড়ীর চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝে অন্ধকার বিমর্ষ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য ময়। সুন্দর অথচ বেমানান। তখন বুঝিনি এমন কেনো লেগেছিল। একবার আমাদের ওদিকে কোনো এক শ্মশান কালির পুজোয় কেউ ভুল করে দুর্গা প্রতিমা এনেছিল। অনেকটা ওরকম সুন্দর! রুমি ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কেমন লাগছে। আমি তখন কি বলেছিলাম মনে নেই এখন হলে বলতাম শ্মশান কালির পুজোর দুর্গা প্রতিমাটার মতো! এরপর রুমি ভাই ঢাকা চলে যান। আর কখনো বাড়ি আসেননি। চারুলতাদি আজ এক বছর হলো বিধবা। আচ্ছা, চারুলতাদি কি জানেন খবর টা! ভেবে গলা ধরে এলো! বাবার বকাবকিতে সম্বিত ফিরল। এইরে ধরা পড়ে গেছি! পেপার কাটিং গুলো এইবার বোধয় বাবা পুড়িয়েই দেবেন!